১০ দিনে ১১ হাজার ৬৬০ কিলোমিটার

কুয়াকা পাখির পরিযায়ন

দশ দিনে ১১ হাজার ৬৬০ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে পাখিটি তার গন্তব্যে অবতরণ করল। পুরো ফ্লাইটটি ছিল বিরতিহীন। বর্তমানে মানুষের তৈরি উড়োজাহাজ এর চেয়ে দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করে ঠিকই; কিন্তু ১০ দিন একটানা ওড়ার রেকর্ড নেই।

এই পাখির ইংরেজি নাম Bar-tailed Godwit. এরা স্বল্প সংখ্যায় শীতকালে আমাদের দেশেও আসে। তাই বাংলা নাম আছে-দাগিলেজ-জৌরালি।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জ পলিনেশিয়ার অধিবাসীরা অর্থাৎ পলিনেশিয়ানরা আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে খেয়াল করে দেখল, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ কিছু পাখি ঝাঁক বেঁধে দক্ষিণ দিকে উড়ে যায়। তারা চিন্তা করল, ওগুলো তো সাগরের পাখি নয়, তাহলে ওরা যায় কোথায়! নিশ্চয় দক্ষিণ দিকে কোনো স্থলভাগে ওরা পরিযায়ন করছে। শুধু এই ধারণার উপর ভরসা করে সাগরে চলার উপযোগী ক্যানোতে চড়ে একদল অভিযাত্রী দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করল।   

তাদের ধারণা ভুল ছিল না। কিছুদিন চলার পর তারা খেয়াল করল দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল একখণ্ড মেঘ গিয়ে শেষ হয়েছে অদেখা একটি স্থলভাগের উপর। তারপর তারা সেখানে গিয়ে অবতরণ করে। নতুন আবিষ্কৃত ভূখণ্ডটির নাম দেয় এওটিয়ারোয়া (লম্বা মেঘের দেশ)। আমরা সবাই সেই দেশটিকে নিউজিল্যান্ড নামে চিনি। তাদের দেওয়া পাখিটির নাম কুয়াকা।   

কুয়াকা পাখির পরিযায়নের স্যাটেলাইট চিত্র।

আনুমানিক ৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে পলিনেশিয়ানরা কুয়াকা অর্থাৎ দাগিলেজ-জৌরালি পাখির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেই নিউজিল্যান্ড গিয়ে হাজির হয় এবং তারাই সেখানে প্রথম পদার্পণকারী। এই আদিবাসীদের বংশধররা এখনো সে দেশে আছে নাম, মাওরি। এও বোঝা গেল দাগিলেজ-জৌরালি পাখি হাজার বছরের বেশি সময়কাল ধরে সেই পথে পরিযায়ন করছে। এখন দেখা যাক সাম্প্রতিককালে কীভাবে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য আবিষ্কৃত হলো! 

প্রথমে পাখিটির স্বল্প বর্ণনা। দাগিলেজ-জৌরালি ঠোঁটের মাথা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে ১৬ ইঞ্চি এবং ডানার বিস্তার ৩১ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। পুরুষ পাখির সর্বোচ্চ ওজন ৪০০ গ্রাম, স্ত্রী পাখি ৬৩০ গ্রাম। পূর্ণ বয়স্ক পাখির পা দুটো তামাটে নীল এবং কিছুটা খাটো। লম্বা দুই রঙা ঠোঁটটি সম্মুখভাগ কিছুটা উপরের দিকে বাঁকানো। সেটির গোড়ায় রঙ গোলাপি, সামনের দিকে কালো। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির ঘাড়, বুক ও পেটের পালক ইট লাল, উপরে গাঢ় খয়েরি। স্ত্রী পাখির প্রজনন পালক তুলনামূলকভাবে ফ্যাকাশে। এই পাখির বাউরি উপপ্রজাতিটি আলাস্কায় প্রজনন করে এবং শীতকাল কাটায় প্রধানত নিউজিল্যান্ডে।  

২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ওয়েটল্যান্ডস ইকোলজি ডিভিশনের 

কো-অর্ডিনেটর নিলস ওয়ারনক এবং এঙ্করেজ আলাস্কায় অবস্থিত ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে অফিসের বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানী বব গিল পর্যবেক্ষণ করছিলেন একটি স্ত্রী দাগিলেজ-জৌরালি পাখির ফ্লাইট। তারা কম্পিউটারে খেয়াল করলেন ই৭ (E7) নাম দেওয়া সেই পাখিটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিরে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী বিরতিহীন একটি রেখা তৈরি করে চলেছে।

পাখিটির শরীরে শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে বসিয়ে দেওয়া অত্যন্ত হালকা স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫১০ মাইল উপরে ন্যাশনাল ওসিয়ানিক অ্যান্ড অ্য্যাটমোসফিয়ারিক অ্য্যাডমিনিস্ট্রেশন উপগ্রহে নিয়মিত সংকেত প্রেরণ করে যাচ্ছিল। 

ইয়েলো সি’র কাদাচরে ভোজনরত কুয়াকা পাখি। ছবি: জেরিট ভাইন

পাখিটি এই সুদূর উড্ডয়নের আগে কিছুদিন ধরে অসংখ্য একই প্রজাতির পাখি ও অন্যান্য সৈকত পাখির সঙ্গে আলাস্কার পশ্চিমে ইউকন ও কুস্ককউইম নদীদ্বয় বেরিং সাগরে পড়ার মুখে কাদাচরে ব্যাপকভাবে ভোজনরত ছিল। তারা মূলত পানি ও কাদার ভেতরের পোকা ও ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী খেয়ে থাকে। অস্বাভাবিক ভোজনের উদ্দেশ্য, দীর্ঘ উড্ডয়নের জন্য পর্যাপ্ত চর্বি জমানো যা পুড়ে তার ভ্রমণের জ্বালানি জোগাবে।

সম্ভবত আবহাওয়া পরিস্থিতি মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে, ২৯ আগস্ট ২০০৭ সারাদিন সে বেশ কয়েকবার আরও কয়েকটি সমগোত্রীয় পাখির সঙ্গে উপরে উঠে কয়েকবার চক্কর দিয়ে আবার অবতরণ করে। একই দিন সন্ধ্যার দিকে সূর্যাস্তের দু-এক ঘণ্টা পূর্বে সে আবার আকাশে ওঠে, এবার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ক্রমাগত উড়ে যেতে থাকে।

বলা বাহুল্য, এ ধরনের উড্ডয়ন হয় সাধারণত ঝাঁক বেঁধে। উড্ডয়নের সময় নেতৃত্বে থাকে দলের সিনিয়ররা, তরুণরা তাদের অনুসরণ করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই পাখিটি আলাস্কার প্রান্ত অতিক্রম করে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর অভিমুখে যাত্রা করে। 

গিল আশা করছিলেন, পাখিটির স্যাটলাইট ট্রান্সমিটারের ব্যাটারিটি যেন পুরো ফ্লাইটে সচল থাকে যাতে করে, তার ধারণা মোতাবেক দক্ষিণ দিকে নিউজিল্যান্ড অভিমুখী এই পরিযায়নটি পর্যক্ষেণ করা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে সব পাখি উত্তর-দক্ষিণ দিকে পরিযায়ন করে, তারা সাধারণত নিচে দৃশ্যমান বিভিন্ন তটরেখা অনুসরণ করে চলে। কোনো কোনো প্রজাতি বিশ্রাম ও আহার করে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সেসব সৈকতে অবতরণ করে ক্ষণস্থায়ী অবস্থান করে; কিন্তু, ই৭ তা করেনি।    

পাখিদের কাছে প্রশান্ত মহাসাগর একটি অনুর্বর মরুভূমির মতো যেখানে আহারের জন্য অবতরণ করা একটি মারাত্মক ভুল। ই৭ এশিয়ার উপকূলের দিকে না গিয়ে গিলের ধারণা অনুযায়ী দক্ষিণমুখী উন্মুক্ত মহাসাগরের দিকে রওনা দেয়। তিন দিন পরে দুপুরের দিকে নীল মহাসমুদ্রের উপর আনুমানিক দুই মাইল ঊর্ধ্বাকাশে তাকে চলমান দেখা যায়।

তখন সে হনুনুলুর ৪০০ মাইল পশ্চিম দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এবং নিশ্চয় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের তটরেখার চমৎকার দৃশ্যও দেখছিল! তার দুদিন পর সে ফিজির ৩০০ মাইল উত্তর-পূর্বে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ মধ্যরেখা অতিক্রম করে যায়। অতঃপর ২০০৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে সে নিউজিল্যান্ডের উত্তরপ্রান্তে নর্থ কেপের দিকে অগ্রসর হয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর সে পিয়াকো নদীর মুখে, যে স্থানে তাকে সাত মাস পূর্বে গবেষণার জন্য জাল পেতে ধরা হয়েছিল, সে স্থান থেকে আট মাইল দূরত্বে কাদাচরে অবতরণ করে। এই ১০ দিন বিরতিহীন ঘণ্টায় ৩৫ মাইল বেগে উড়ে যেতে সে ১১ হাজার ৬৬০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে।   

এটিই হলো মানুষের কাছে রক্ষিত একটি পাখির দীর্ঘতম পথ একনাগাড়ে উড়ে চলার রেকর্ড। এই বিরল ঘটনাটি গিল তার ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে দলের সহকর্মীদের কাছে বলার সময় তারা অবিশ্বাস নিয়ে শুনছিলেন। গিলও তা বর্ণনা করার সঠিক ভাষা ও শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।  

অবশ্য বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানী বব গিল অবিশ্বাস্য বিষয়টি বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে না পেলেও, তার ধারণা ছিল এটা কীভাবে সম্ভব। অন্য সৈকত পাখিদের মতো দাগিলেজ-জৌরালির লম্বা চোখা পাখা আছে যা বাতাসে কম বাধাপ্রাপ্ত হয়। আরও আছে চকচকে অ্যারোডাইনামিক শরীর। আর বিরতিহীন পরিশ্রম করার শক্তি আসে এর শরীরে জমানো চর্বি থেকে, যা সে জমিয়েছিল পরিযায়ন উড্ডয়ন শুরু করার বেশ কিছুদিন আগ থেকে।

এটাই জ্বালানির কাজ করে। চর্বি জমিয়ে এরা স্বাভাবিক ওজনের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই চর্বি উড্ডয়নকালে অন্যান্য শর্করা বা প্রোটিন থেকে দ্বিগুণেরও বেশি শক্তি সরবরাহ করে। উপরন্তু ব্যাপক ভক্ষণ করে শক্তি সঞ্চয়ের সময় এদের পাকস্থলী ও অন্ত্র অতিরিক্ত চর্বিকে জায়গা দেওয়ার জন্য সংকুচিত হয়ে যায়। কারণ পরিযায়ন উড্ডয়নকালে পাকস্থলী ও অন্ত্রের কোনো ভ‚মিকা থাকে না। তবে এরা কম শক্তি খরচ করে দীর্ঘ সময় ওড়ার কৌশল 

প্রাকৃতিকভাবেই জানে। এই সব বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপাদানের উপস্থিতির কারণেই এই পাখিটি অবিশ্বাস্য পরিযায়নে সমর্থ হয়। তবে এই ফ্লাইট শেষে অবতরণের সময় তার শরীর চর্বি নিঃশেষ হয়ে বেশ শুকিয়ে যায়।   

বব গিল নিজেই গবেষণার জন্য আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডে ওদের অবতরণ ও বসবাসের সেই সৈকতে গিয়ে 

দাগিলেজ-জৌরালি পাখি জাল পেতে ধরেন, পায়ে রিং পরিয়ে অথবা স্যাটলাইট ট্রান্সমিটার লাগিয়ে ছেড়ে দেন। সেখানে তিনি সেদেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করেন।  

দাগিলেজ-জৌরালি পাখিদের প্রত্যাবর্তন ফ্লাইটটিও কোনো অংশে কম মজাদার নয়। এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ ধরে প্রজনন ভূমিতে ফিরে আসে। সেপ্টেম্বর মাসে নিউজিল্যান্ড পৌঁছে তারা সেখানে মার্চ মাস পর্যন্ত অবস্থান করে। এই সময়ে তারা পর্যাপ্ত খেয়ে আবারো চর্বি জমিয়ে ফেলে। মার্চ মাসেই তারা ফিরতি পরিযায়নের উড্ডয়ন শুরু করে, এবার তারা উড়ে চলে ইয়েলো সাগরের দিকে।

চীন ও কোরিয়ার মধ্যবর্তী এই জলাশয়ে রয়েছে আট হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত বিশাল অগভীর উপকূল। এই উপকূলব্যাপী কাদাচরগুলো জোয়ারে ডুবে যায়, আবার ভাটায় ভেসে ওঠে। চমৎকার এই ব্যবস্থাটি ৫০ লাখের বেশি সৈকত পাখির আবাসভূমি হিসেবে কাজ করে।

সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, পরিযায়ী দাগিলেজ-জৌরালি পাখিদের একটি বড় অংশ ইয়ালু জিয়াং নদীর মুখে চার লাখ ৫০ হাজার একরব্যাপী ইয়ালু জিয়াং ন্যাশনাল নেচার রিজার্ভে পাঁচ সপ্তাহের মতো অবস্থান করে। ইয়ালু জিয়াং নদী উত্তর কোরিয়া ও চীনের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে।

চীন ও কোরিয়ায় কিছুদিন খাদ্যগ্রহণ ও বিশ্রামের জন্য কাটিয়ে তারা আবার প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে আলাস্কায় তাদের প্রজনন ভ‚মিতে ফিরে যায়। সেখানে প্রজনন শেষে তারা আবার তরুণ সন্তানদের নিয়ে আগস্ট মাসের কোনো এক সময়ে নিউজিল্যান্ড অভিমুখী সেই সুদূর পরিযায়ন শুরু করে। 

অন্য সব বন্যপ্রাণীর মতো সৈকত পাখিরাও মানবজাতির ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মূল্যবান ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে সৈকতে তাদের উপস্থিতি ভাঙন রোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। 

মানুষের বিভিন্ন ভ্রান্ত কার্যকলাপের কারণে সৈকত পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। কয়েকটি প্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। অপরিকল্পিত বন্দর নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় থেকে কৃষিকাজে পানি স্থানান্তর সৈকত পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস করে ফেলছে। এই কাজগুলো পরিকল্পিতভাবে করলে পরিবেশ রক্ষা পেতে পারে। সেটি খুব কঠিন কিছু নয়। 

তথ্যসূত্র: দি কর্নেল ল্যাব। 

লেখক: ইতিহাস ও প্রকৃতি অনুসন্ধানী।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //